জন বোল্টন-অখ্যাতিপূর্ণ সব কর্মকাণ্ড দিয়ে গত এক বছর দুনিয়ার সাধারণ মানুষকে আতঙ্কে রেখেছেন। বোল্টনের প্রতিটি ভাষ্যেই এই বুঝি যুদ্ধ লেগে গেল অনুভব পেয়েছে সাধারণ মানুষ। দায়িত্বের প্রথম দিনেই বোল্টন স্কাই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রোমান সাম্রাজ্যের নমুনা টেনে রাখঢাক না রেখেই শান্তির জন্য যুদ্ধের অনিবার্যতার কথা বলেছিলেন। বোল্টন কথা রেখেছেন। আফগানিস্থান, সিরিয়ায় আলোচনার বিপক্ষে অবস্থান আর উত্তর কোরিয়া, ইরান ও ভেনেজুয়েলায় নতুন করে রোমান সাম্রাজ্যের কায়দায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে ট্রাম্পকে দিয়ে যুদ্ধের আয়োজনের প্রায় শেষ পর্যায় ছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের বড় খামখেয়ালি রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের এই টুইটে মধ্যপ্রাচ্য আর ল্যাটিন আমেরিকার সাধারণ মানুষ কিছুদিনের জন্যও হলেও স্বস্তির নিশ্বাস নিয়েছেন, বোল্টন মার্কা শান্তি থেকে স্বল্প সময়ের জন্য দূরে থাকার নিশ্চয়তা নিয়ে।
তবে ধবধবে বোল্টন সাহেব নিঃসঙ্গ নন যুদ্ধের মাধ্যমে শান্তি প্রণয়নের নীতিতে। নিক্সন-কিসিঞ্জার, জুনিয়র বুশ-কন্ডোলিৎসা রাইস আর ওবামা-সুসান রাইস জুটি ত্রয়ী বোল্টনের সঙ্গী, যারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে এই নীতির অবলম্বনে শান্তির পায়রা উড়িয়েছেন। প্রথম জুটি দ্বয়ের মতো ওবামা-সুসান জুটির জায়গা এখন পর্যন্ত ইতিহাসে মজবুত না হলেও তাঁদের বইয়ে দেওয়া শান্তির বাতাসে মধ্যপ্রাচ্য টালমাটাল। তবে ওবামা কিন্তু ঠিকই নোবেলের শান্তি পুরস্কার বাগিয়ে নিয়ে নিক্সন আর বুশ জুনিয়র থেকে নিজেকে কিছুটা আলাদা করেছেন। ওবামার মতো ট্রাম্পও নোবেল চান। তাই ত্বরিত গতিতে বোল্টনের লাগাম টেনে ট্রাম্প তাঁর খায়েশের পরিষ্কার বর্ণনা দিলেন, যা সাম্প্রতিক প্রকাশিত হয়েছে সাবেক পূর্ব এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টোফার আর হিলের কলমে।
নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি খ্যাতি অর্জন করেছেন ল্যাটিন আমেরিকায় তখনকার সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দের বিরুদ্ধে জেনারেল আগাস্তো পিনোশের সামরিক ক্যুতে সরাসরি সমর্থন দিয়ে। আলেন্দের অপরাধ ছিল, তিনি লাতিন আমেরিকায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য দূর করার মানসে ছিলেন। আলেন্দের কলকারখানা জাতীয়করণ আর ভূমি সংস্কার মার্কিনিদের ব্যবসার গতি টেনে ধরে সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে। সমাজতন্ত্রে এই বিপুল আগ্রহ মার্কিনিদের আলেন্দের বিরুদ্ধে পিনোশের ক্ষমতা দখলে সমর্থন দেয়। যে লড়াইয়ে হাজার হাজার মানুষ নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে রক্ষার জন্য মার্কিনিদের দেশীয় সহযোগীদের হাতে প্রাণ হারায়। পরের ইতিহাস আরও বেশি নির্মম। পিনোশের নির্মমতায় খুন হয়েছেন, লাখ লাখ মানুষ, মার্কিনি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ফিরে এসেছে, দারিদ্র্য বেড়েছে আর ফিকে গেছে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আশা। পিনোশকে আইনের মুখোমুখি হতে হয়েছে অল্প সময়ের জন্যও। ২০০৬ সালে মারা যান ৩০০ ও বেশি মামলার অপরাধ নিয়ে। কিন্তু উসকানিদাতাদের বিচার হয়নি, বিচার হয়নি তদানীন্তন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কিসিঞ্জার মাঝে মাঝেই পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমে শান্তির কথা বলেন।
হালের নব্য কিসিঞ্জার, জন বোল্টনও ল্যাটিন আমেরিকার আরেক দেশ ভেনেজুয়েলাতে হামলার পক্ষে অবিরাম ভাবে ট্রাম্পকে রাজি করাতে কাজ করেছেন। কিন্তু পেশায় বণিক ট্রাম্প সম্মুখ সমরে লাভ দেখলেন না। নিন্দুকেরা বলেন, নোবেল প্রাপ্তির আশা উজ্জ্বল করতেই ট্রাম্পের সামরিক আগ্রাসনে সায় ছিল না।
বুশ জুনিয়র-কন্ডোলিৎসা রাইস ও নিক্সন-কিসিঞ্জার পথে হেঁটেছেন। আফগানিস্থানের নারীদের ‘মোল্লাতন্ত্র’ থেকে মুক্ত করে স্বাধীন দুনিয়ার স্বাদ দিতে যুদ্ধ দিয়ে শান্তি চেয়েছেন। এক সময়কার মার্কিন প্রতিপালিত তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দিয়ে মার্কিনরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে অনবরত যুদ্ধ যুগের সৃষ্টি করেছিল, যার কবজায় আটকা পরেছে অন্তত পক্ষে কয়েক ডজন দেশ। ১৮ বছর আর প্রায় ১০০০ বিলিয়ন ডলারের এই যুদ্ধ প্রাণ নিয়েছে দুই লাখ মানুষের কিন্তু নারীদের মুক্তি হয়নি, আফগানিস্থানের অধিকাংশ এলাকা এখনো তালাবানের কব্জায়। বুশ জুনিয়র-কন্ডোলিৎসা জুটির শান্তি আর গণতন্ত্রের নামে এই যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়েছে ইরাকেও, সাদ্দাম হোসেন থেকে বিশ্বকে নিরাপদ করার নামে। ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী দশকের পর দশক খুঁজে মারণাস্ত্রের দেখা পায়নি। আদতে যা কখনোই ছিল না সাদ্দামের থলিতে। মিথ্যার ওপর ভর করে বুশ জুনিয়র-কন্ডোলিৎসা আর কলিন পাওয়েল পুরো ইরাকি সভ্যতাকেই ধূলিসাৎ করে দিলেন। পশ্চিমারা ইরাক যুদ্ধের ভুল স্বীকার করেছেন কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা আর ফেরেনি।
তালেবানদের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতায় জন বোল্টন যেমন সরব ছিলেন, বুশ জুনিয়র-কন্ডোলিৎসা রাইস জুটিও তেমনি ভাবে সাদ্দামের সঙ্গে আলাপ আলোচনার বিরোধিতায় ছিলেন। কন্ডোলিৎসা রাইস হয়তো ওবামার মতো নোবেল পাননি কিন্তু পেয়েছেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকার চাকরি। কিসিঞ্জারে মতো তিনিও সময়ে সময়ে পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমে শান্তি আর মার্কিনিদের নীতি কথা শোনান।
কিসিঞ্জার-কন্ডোলিৎসার মতো জন বোল্টনও ক্যু আর বোমা দিয়ে শান্তির পত্তন ঘটাতে চেয়ে ছিলেন ইরান ও ভেনেজুয়েলাতে। কিন্তু আপাতত কিছুদিনের জন্য থেমে থাকছে তা। ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হতে চান এবং নির্বাচনের আগে তিনি পরিষ্কার ভাবে কোনো যুদ্ধে যেতে চান না। তবে যুদ্ধাবস্থা জিইয়ে রাখতে চান, নির্বাচনে জেতার তাগিদে।
কিসিঞ্জার-কন্ডোলিৎসা আর ওবামার বিদায়ের পর বিশ্বজুড়ে ক্ষণস্থায়ী আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল ঠিক যেভাবে জন বোল্টনের বিদায়ে আশার আলো দেখছে তুরস্ক, ইরান, ভেনেজুয়েলা, উত্তর কোরিয়া আর আফগানিস্থানের সাধারণ মানুষেরা। ইরানের আন্দোলিত অবস্থা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফের টুইটে পরিষ্কার। যুদ্ধের নীতি হয়তো ২০২০ এর নির্বাচনের জন্য কিছুদিনের জন্য থেমে যাবে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে রোমানদের কায়দায় শান্তি স্থাপনের নামে নতুন একজন বোল্টনের পরিচালনায় ইরানে যুদ্ধের মাধ্যমে শান্তির আয়োজনের সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া যায় না।
রাহুল আনজুম
হেইবেলি আদা, ইস্তানবুল