daf78baa-dec3-11e9-b8e0-026e07cbe5b4
Rahul Anjum

Rahul Anjum

নব্য সুলতানের প্রস্থান রথ

আজকের ইস্তাম্বুল, পুরোনো নামে কনস্টান্টিনোপল, পাশ্চাত্য সাহিত্য ও ইতিহাসে অনুরাগ মিশ্রিত নাম। অনেক নামজাদা ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিকেরা সাবেক বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের এই রাজধানী কে আদর করে দ্বিতীয় রোম নামে পরিশুদ্ধ করেন। হাজার বছরের নীল পানির এই ঐতিহাসিক নগরী বাইজান্টাইন সঙ্গে সঙ্গে অটোমানদের রাজধানীর তকমাও বহন করছে। ভূ রাজনৈতিক সহ নানান কারণে সবার চোখের মণি ইস্তাম্বুল গত দুই হাজার বছরে নানান উত্থান-পতনের নিষ্ঠুর সাক্ষী। তবে গত শতাব্দীর শেষ দশকে ইস্তাম্বুল এক রাজনৈতিক নেতার নাম জিকির করা শুরু করে, রিসেপ  তাইয়েপ  এরদোয়ান। তাঁর পরের ইতিহাস সবার জানা। ১৯৯৪ থেকে ২০১৯, একদম টানা পঁচিশ বছর এরদোয়ান নিজে এবং তাঁর রাজনৈতিক দল এই শহরে রাজত্ব করেছে দোর্দণ্ড প্রতাপে। গত ৩১ মার্চের স্থানীয় নির্বাচনে  এরদোয়ানকে না বলে ইস্তাম্বুলের মানুষ গত দুই দশকের এক বিস্ময়কর ও বিতর্কিত এক রাজনৈতিক অধ্যায়ের ইতি টেনেছেন কিন্তু তিন দশক আগে এরদোয়ানের রাজনৈতিক হাতে খড়ি হয়েছিল এই ইস্তাম্বুলেই। নিন্দুকেরা ক্ষমতার এই হাত বদলকে নব্য সুলতানের শেষের শুরু হিসেবেই দেখছেন। 

কিন্তু সুলতান বসে থাকার পাত্র নন, নির্বাচনে গোপন কারচুপির অভিযোগ আনেন দলিল-দস্তাবেজ সহকারে। আবেদন করেন নতুন করে নির্বাচনের। শুরুর দিকে নির্বাচন কমিশন আবেদন বাতিল করে দেয় কিন্তু পরে খোদ নির্বাচন কমিশনের অনুসন্ধানেই ব্যাপক অনিয়ম ও অভিযোগের সন্ধান মিলে। এই অভিযোগের সন্ধান আর সমাহার সবকিছু বদলে দেয়। একেপি প্রায় বেয়াল্লিশ হাজার ভোট ব্যবহারকারীর সম্বন্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানায়, যার মধ্যে ছিলেন ছিলেন প্রতিবন্ধী, মৃত, দণ্ডিত অপরাধীরা। একেপির দলিল মতে, প্রায় এ রকম একচল্লিশ হাজার ভোট তাদের বিপক্ষে ব্যবহিত হয়েছে। এই একচল্লিশ হাজার ভোটর হাজারো অভিযোগের একটি। 

তবে একেপির যে অভিযোগ সবার টনক নড়েছে তা হলো-নির্বাচন কমিশনের কানুন মতে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরাই একমাত্র ভোট কেন্দ্রের প্রধান হতে পারবেন কিন্তু অলৌকিক ভাবে ইস্তাম্বুলের ত্রিশ হাজারেরও বেশি ভোট কেন্দ্রের প্রায় সাত শ চুয়ান্ন ভোট কেন্দ্রের প্রধান হয়েছেন যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নন। কেন্দ্রের প্রধান হয়েছেন পরিচয় লুকিয়ে অথবা ছলনার আশ্রয় নিয়ে। একেপির ভাষ্য মতে এই সব ভোট কেন্দ্র প্রধানেরা নিষিদ্ধ ঘোষিত গুলেন সংগঠনের অনুসারী এবং তারা নির্বাচনে একেপির ভোট চুরি করেছেন। তাদের দাবির পক্ষে যুক্তির সমাহার ছিল। উদাহরণে বলা যায় সানজাকটেপে মাহাল্লে এক ভোট কেন্দ্রে একেপি প্রার্থী বিনালি ১৩১ ভোট পেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর নামে মাত্র ১ ভোট লেখা হয়েছিল। এ রকম অন্তত পক্ষে কয়েকশ অভিযোগ দাখিল করেছে একেপি দলিলসহ। নির্বাচন কমিশনের দলিল মতে প্রায় শ খানেক কেন্দ্রের ভোট গণনার কোনো দলিল ছিল না, ছিল না কোনো সাক্ষর। 

কিন্তু এখানেই সাধারণ মানুষের প্রশ্ন-নির্বাচন কমিশন কীভাবে যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নন তাদের ভোট কেন্দ্রের প্রধান বানালেন। একেপি সহ অন্যান্য দলের অভিযোগও এখানে। তাদের মতে নির্বাচন কমিশনে গুলেন মুভমেন্টের সক্রিয় চক্র এই কাজ করে নির্বাচনে একেপিকে হারিয়ে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন ইস্তাম্বুলে আবার নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে ২৩ জুন। আবার পুরোনো প্রার্থীরাই লড়বেন তবে গণতন্ত্রের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গের মাধ্যমে তা এরদোয়ানসহ তাঁর একেপির আগামীর দিনগুলোকে কঠিন করে তুলবে। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস একেপির সঙ্গে সঙ্গে আর যে নির্বাচন কমিশন পাচ্ছে না তা পরিষ্কার নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন বাতিলের কারণ সমূহ নিবন্ধিত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর। 

ইস্তাম্বুলে একেপির প্রার্থী ছিলেন রাজনীতির এক পরিচিত নাম, এরদোয়ানের প্রায় তিন দশকের পুরোনো বন্ধু, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার বিনালি ইলদিরিম। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিনালি হেরে যাবেন তা হয়তো বিরোধীদেরও অনুমানে ছিল না। সীমাহীন নাটক হয়েছে নির্বাচন পরবর্তী ফলাফল আর উভয় প্রার্থীর জয়ের দাবি নিয়ে। নির্বাচন পরবর্তী প্রায় দুই সপ্তাহ ভোট পুনঃ গণনার কাজ শেষে নির্বাচন কমিশন বিরোধী জোটের প্রার্থী ইকরাম ইমামওলূকে বিজয়ী ঘোষণা করে। তবে সামগ্রিক রাজনৈতিক উত্তাপ থেকে আন্দাজ করা যায় নির্বাচন পরবর্তী ফলাফল যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে তা থামবে না বরং আগামীর রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্র বিন্দু হবে। 

প্রধান দুই শহর আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলের, কর্তার চেয়ার হারালেও শহরের অধীনস্থ  পৌরসভা গুলোতে একেপি আবার একচেটিয়া ভাবে জিতেছে। বিদেশি ফিরিঙ্গীরা, যারা কিনা তুরস্কের ভোটের রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রে বারবার অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন, তাদের জন্যও আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলের অন্তগত পৌরসভা গুলোতে একেপির ত্রাসের জয় নতুন কোনো কিছু ছিল না। আঙ্কারার ২৩ / ১৯টি আর ইস্তাম্বুলের ৩৯ / ২৪টি জিতেছে। প্রতিটি সিটি করপোরেশনের আলাদা আলাদা পার্লামেন্ট থাকায় নতুন এই মেয়ররা হয়তো স্বাধীন ভাবে তাদের আশা অনুযায়ী বিল পাশ করতে পারবেন না তবে তাদের নতুনত্ব যে এক নতুন দিনের শুরু হচ্ছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে এরদোয়ান ও একেপি এই পরিবর্তনের রাজনীতির সঙ্গে কতটা খাপ খাওয়াতে পারবেন। ইতিহাস বলে, প্রতিটি আন্দোলনই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর আবেদন হারায় যদি না তারা পরিবর্তিত না হয়ে অথবা নতুন কোনো কর্ম পদ্ধতি না বানায়। আমাদের ঘরের পাশে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট শাসন করেছিল ২৯ বছর কিন্তু আজ ভারতীয় রাজনীতিতে তাদের অবস্থান দুরবিন দিয়ে খুঁজে দেখতে হয়। 

এ কথা না মেনে উপায় নেই যে নির্বাচনের আগেই আগ্রহী মানুষদের খটকা ছিল ইস্তাম্বুলে নিয়ে, কিন্তু আঙ্কারা, ইযমির, আদানা, আনতালইয়া নিয়ে কোনোভাবেই নয়, অন্তত পক্ষে যারা একটি নিরপেক্ষ জমিনে দাঁড়িয়ে ভোটের মাঠের সমীকরণ বুঝতে চান। মোট জাতীয় ভোটারের ২২ শতাংশ, প্রায় এক কোটি ভোটারের ইস্তাম্বুলে সব দলের নজর ছিল বাঘের মতো। স্থানীয় নির্বাচনে এই আক্রমণাত্মক জয় দিয়ে বিরোধী দলগুলোর আবার রাজনীতির মাঠে প্রত্যাবর্তন, গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার সর্বশেষ দুর্গ হিসেবে যারা দেখছেন, তাদের মধ্যে অন্ততপক্ষে এরদোয়ানের কট্টর সমার্থকদের ও একটি অংশ জায়গা নিতে আগ্রহী। কারণ, বিগত কয়েক বছরের একচেটিয়া শাসন, বিরোধীদের কঠোর ভাষায় দমন, পার্টির মধ্যে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও কট্টর তুর্কি জাতীয়তাবাদী বনে যাওয়া। হঠাৎ করে তার জাতীয়তাবাদী বনে যাওয়া তার সমর্থকদের বেশি ধাঁধায় ফেলেছে। 

ইসলামে জাতীয়তাবাদের অবস্থান ও পরিধি নিয়ে আলাপ আলোচনা নতুন নয়, তালাল আসাদ, আশিস নন্দী, ওয়ায়েল হাল্লাক থেকে শুরু করে অনেক বড় নৃবিজ্ঞানীরা, ইসলামে জাতীয়তাবাদের অবস্থান, সংকট ও বেখাপ্পা আবদারের বয়ান বর্ণনা করেছেন সবার সমাদৃত বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান চর্চায় মাধ্যমে। আর এই জাতীয়তাবাদ তো সেই জাতীয়তাবাদ, যার আগুনে পুড়ে ছারখার হয়েছিল উসমানী সাম্রাজ্য। প্রধানমন্ত্রিত্বের শুরুর দিকে, ট্রাম্প, মোদি আর পপুলিজমের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত, যেই এরদোয়ান প্রকাশ্যে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তুর্কি সেক্যুলার জাতীয়তাবাদের চিহ্ন পৃথিবীর ইতিহাস থেকে বিদায় করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কিন্তু সিরিয়ার যুদ্ধের দীর্ঘ সুত্রিতার পর্দার আড়ালে যে তুরস্কের স্থিতিশীলতা নষ্ট ও দীর্ঘ মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জিইয়ে রাখার পাঁয়তারা অনুধাবনের পর সেই এরদোয়ান নীতিগত অবস্থান পরিবর্তন করে কট্টর ও নিষ্ঠুর জাতীয়তাবাদী সেজে দেশ রক্ষার কাজে নেমে জান। তাঁর এই দেশ রক্ষার আবদারের খেসারত দিতে হয়েছে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে। 

একদা এরদোয়ান বলেছিলেন, ইস্তাম্বুল তুরস্কের অন্তর, যারা ইস্তাম্বুলে বিজয় অর্জন করবেন তারা সারা তুরস্ক শাসন করবে, আর দুনিয়া তাদের আওয়াজ মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। গত প্রায় দুই দশক ধরে এরদোয়ানের সাফল্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইস্তাম্বুল, উৎস ছিল সকল ধরনের মানসিক শক্তির ও রাজনৈতিক শক্তির উদ্ধত মঞ্চ। এই শক্তির মঞ্চকে কেন্দ্র করে এরদোয়ানের নির্বাচনী স্লোগান ছিল-ইস্তাম্বুল আমার ভালোবাসা। এরদোয়ানের সেই ভালোবাসার শহর নির্মম ভাবে এরদোয়ানকে প্রত্যাখান করেছে অন্তত পক্ষে ভোটের রাজনীতিতে তা পরিষ্কার। ঐতিহাসিক এই নীল পানির নগরী তাঁর সঙ্গে আবার এক ঘরে উঠবেন কিনা তা আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্রোত আর এরদোয়ানের আগামীর ইশতেহার তা নির্ধারণ করবেন। তবে প্রত্যাখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে দ্বিতীয় ঘরে সুখ শান্তিতে কেও জীবন অতিবাহিত করেছে কিনা তাঁর নজির বিরল। পৃথিবীর বিরল ঐতিহাসিক এই নগরী আবার নির্বাচনে যাবে তাদের নগর পিতা ঠিক করার জন্য জুনের ২৩ তারিখ। সময় বলে দেবে বসফরাসের স্রোত কার পক্ষে যায়। 

রাহুল আনজুম 

হেইবেলি আদা, ইস্তানবুল 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share this post

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on pinterest
Share on print
Share on email